মালিকের কানে পৌঁছেনা শ্রমিকের কান্না

প্রকাশঃ মে ১, ২০১৫ সময়ঃ ৩:২৬ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৬:৩৮ অপরাহ্ণ

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার

forget-lunchমে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন। মে মাস আসলে ঘটা করে এ দিনটি পালন করা হয়। বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ লা মে জাতীয় ছুটির দিন।

আজ থেকে ১৩১ বছর পূর্বে আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার ১৮৮৪ খ্রি. ৭ অক্টোবর প্রথম আট ঘন্টা কাজের দাবী তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর ‘হে মার্কেটে’র শ্রমিকরা ১৮৮৬ খ্রি. ১ মে ধর্মঘট ডাকে। এ ধর্মঘটে যোগ দেয় ৩ লক্ষ শ্রমিক। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৩ ও ৪ মে শ্রমিকদের এক সমাবেশে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ১০ জন শ্রমিক নিহত হয়। ১৮৮৭ খ্রি. সাজানো মামলায় ফাঁসি দেয়া হয় ৪ জন শ্রমিককে। আন্দোলন অব্যহত থাকায় ১৮৮৯ খ্রি.আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস।

এই কংগ্রেসে শিকাগোতে নিহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও সংহতি প্রকাশের জন্য প্রতি বছরের ১ মে দিনটি ঐক্যবদ্ধভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
শ্রমিক আন্দোলনের এ গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৯০ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে মহান মে দিবস।

১৯৩৮ খ্রি.মে দিবস পালিত হয় নারায়নগঞ্জে। মে দিবসে ছুটি চেয়ে দাবী ওঠে সারাদেশে। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১লা মে কে ছুটির দিন ঘোষণা করার ফলে সে বছর থেকেই বাংলাদেশে মে দিবস পালিত হয় ব্যাপকভাবে।

শিকাগো শহরের মতো বাংলাদেশেও মজুরি বৃদ্ধিরদাবী, গার্মেন্টস থেকে অন্যায়ভাবে শ্রমিক ছাটাই ও শ্রমিকদেরকে নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় পুলিশের গুলি খেতে হয়। শ্রমিকদের দমন-পীড়নে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিজিবি সদস্যদেরকেও ব্যবহার করা হয়েছিল।

m13-hay3-mcco-480শ্রমিক তার দাবী নিয়ে কাঁদছে, আর মালিক যথারীতি হাসছে। শ্রমিকের কোন কান্নাই যেন মালিকদের কানে পৌঁছেনা। তাদের কান যেন মূর্তির কানের মতো হয়ে আছে। শ্রমিকরা তার মালিকের কাছে থ্রিজি, ফোর-জি চায়না। দর্শনীয় স্থান আর বিদেশ ভ্রমণের টিকিট চায়না। তাদের চাহিদা পরিবার নিয়ে দু’মুঠো খাবার খেতে, সন্তান কে স্কুলে পাঠাতে, মা-বাবা ও স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু মালিকদের সেচ্ছাচারীতা ও জুলুমের কারণে তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

শ্রমিকরা তার কর্মস্থলেও নিরাপদ নয়। নানাভাবে তাদেরকে জীবন দিতে হচ্ছে। ২০০৫ সালে স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসে ৬৩ জনের মৃত্যু, ২০১২ সনের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১১৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু, ২০১৩ সনের এপ্রিল মাসে রানা প্লাজা ধসে ১১৩৬ জনের মৃত্যুর পরেও মালিকদের শ্রমিক অধিকার বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি।

সম্প্রতি এক বৈঠকে সুইডেন, জার্মান, কানাডা, স্পেন, আমেরিকাসহ ১৪ টি ক্রেতাদেশের রাষ্ট্রদূতরা বিজিএমএ নেতাদের সাথে বৈঠক করে আবারো শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।
যেখানে পোশাক শিল্পের সাথে ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত, সেই তাদের জীবনই সবচেয়ে বেশী ঝুকিপূর্ণ। অনেক শ্রমিক পঙ্গু হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। টাকার অভাবে সুচিকিৎসা হয়না। প্রতিনিয়ত যেন মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

মে দিবস পালনের সাথে জড়িয়ে থাকে সচেতনতাবৃদ্ধি, সেবা, পরামর্শ, নির্দেশনাদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দিবস পালনের সফলতা নির্ভর করে নৈতিক আদর্শের উন্নতির উপর। নৈতিকতা ও আদর্শবিহীন দিবস পালন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে, কর্মস্থলে ও বিভিন্ন লোক সমাগমস্থলে নারী শ্রমিকরা কোন না কোন ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, আট ঘন্টার অতিরিক্ত শ্রম। এ দেশের শিল্প-কারখানার শ্রমঘন্টা এখন মালিকের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তৈরী পোশাক, চামড়া শিল্পসহ বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগের পরিবর্তে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে কাজ করানো হয়। শ্রমিকের পর্যাপ্ত মজুরী,অগ্নি নিরাপত্তা, কারখানা ও গার্মেন্টসের কাঠামোগত দৃঢ়তা, যৌন হয়রানি বন্ধ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, সংশ্লিষ্ট পেশায় শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, নৈতিকতা সম্পর্কে উৎসাহ প্রদান, নিরাপদ কর্মস্থল ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি শ্রমিক-মালিকসহ সকলেরই উত্তম আদর্শ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ইসলামের শ্রমনীতি অনুসরণ করলে শ্রমিক তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেনা।

লেখক : আব্দুল কাহহার , শিক্ষক ও কলামিষ্ট

 

প্রতিক্ষণ/এডি/আরেফিন/নুর

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G